জেনে নিন আশুরার রোজার নিয়ত, রোজা কেন করবেন |Ashurar Rojar Niyot

আশুরার রোজার নিয়ত, রোজা কেন করবেন


আশুরার রোজার নিয়ত, রোজা কেন করবেন
 আশুরার রোজার নিয়ত, রোজা কেন করবেন


মহররম: পবিত্র মাসের তাৎপর্য ও আশুরার গুরুত্ব অনেক কারণ  ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। এটি শুধু একটি পবিত্র মাসই নয়, বরং মানব ইতিহাসের বহু তাৎপর্যময় ঘটনার সাক্ষী। ইসলামপূর্ব আরবের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজেও মহররম মাসকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হতো। পবিত্র কোরআনে এ মাসটিকে চারটি সম্মানিত মাসের একটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।


আল্লাহ তাআলা বলেন:

“নিশ্চয়ই মাসগুলোর গণনা আল্লাহর কাছে বারো মাস, যেদিন থেকে তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস। এটিই প্রতিষ্ঠিত দ্বিন। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোতে নিজেদের ওপর কোনো জুলুম কোরো না।”

(সুরা তাওবা, আয়াত: ৩৬)

আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী, এই সম্মানিত মাসগুলোতে অন্যায়-অপরাধ আরও গুরুতর পাপ বলে গণ্য হয়। একই সঙ্গে নেক আমলগুলোর সওয়াবও অনেক বেশি হয়।

কেন আশুরার রোজা রাখবেন ?:

 চারটি সম্মানিত মাসের একটি হলো মুহাররম। এ মাসের অন্যতম বিশেষ দিনটি হলো আশুরা বা দশ-ই মহাররম। এদিনে আল্লাহর কুদরতে বহু অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। সেসব ঘটনা সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো, জালিম ফেরাউনের কবল থেকে নবী মূসা আ. ও বনী ইসরাইলকে আল্লাহ তাআ’লা এ দিনে মুক্তি দান করেছিলেন। সেজন্যে ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখত। নবী সা. মদীনায় হিজরত করে এসে এ রোজা সম্পর্কে জানতে পেরে তিনিও এ দিনে রোজা রাখতে শুরু করেন এবং সাহাবিদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দেন। এক বছর হয় বারোমাসে । 

পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই  গণনার এ পদ্ধতি বিদ্যমান । আল্লাহ তাআলা বলেন : নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট আল্লাহর বিধানে মাস সমূহের সংখ্যা বারো, যেদিন তিনি আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। (সূরা তাওবা-৩৬)।


হযরত ইবনে আব্বাস রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে তার প্রমাণ মিলে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সা.মাদীনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদীগণ ‘আশুরার দিনে সওম পালন করে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,কি ব্যাপার? (তোমরা এ দিনে সওম পালন কর কেন?) তারা বলল—এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মূসা আ.সওম পালন করেন। আল্লাহর রাসূল সা.বললেন : আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে সওম পালন করেন এবং সওম পালনের নির্দেশ দেন। (সহিহ বুখারী : ২০০৪; হাদিসের মান: সহিহ)।


অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, জাহিলি যুগ থেকেই আশুরার রোজার প্রচলন ছিল। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বরং রাসূল সা. নিজেও রেখেছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা রা. থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, জাহিলিয়্যাতের যুগে কুরাইশগণ ‘আশুরার সওম পালন করত এবং আল্লাহর রসূল সা.-ও এ সওম পালন করতেন। যখন তিনি মাদীনায় আগমন করেন তখনও এ সওম পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমযানের সওম ফরয করা হল তখন ‘আশুরার সওম ছেড়ে দেয়া হলো, যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না। (সহিহ বুখারী-২০০২-হাদিসের মান : সহিহ )।

মহররমের গুরুত্ব এবং আশুরার দিন

আশুরা মহররম মাসের ১০ তারিখ। এটি শুধু ইসলামে নয়, মানব ইতিহাসেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, আশুরার রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়।


ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত:

“আমি নবী করিম (সা.)-কে আশুরার রোজা রাখার বিষয়ে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আগ্রহী দেখেছি।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৮৬৭)


আশুরার ঐতিহাসিক পটভূমি

ইতিহাস বলছে, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখত। কারণ, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। নবী করিম (সা.) যখন এটি জানতে পারেন, তিনি বলেন,

“মুসা (আ.)-কে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার।”

তাই তিনি নিজেও রোজা রাখেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৮৬৫)

ইহুদিরা শুধু দশ-ই মুহাররম রোজা রাখত। এখন যদি মুসলমানগণও শুধুমাত্র সেদিন রোজা রাখে তাহলে ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। এজন্য রাসূল সা. সাহাবিদেরকে নির্দেশ দিলেন, আগে বা পরে একটি রোজা বৃদ্ধি করে দুটি রোজা রাখতে। অতিরিক্ত একটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন ইহুদিদের বিরোধিতা করার জন্য। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত : রাসূল সা. ইরশাদ করেন, তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদিদের বিরোধিতা করো। আশুরার দিনের আগে অথবা পরে একটি রোজা রাখো। (মুসনাদে আহমাদ-২১৫৪)।



এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, কুরআন ও হাদিসে উল্লিখিত সম্মানিত অর্থাৎ জিল-কা’দাহ, জিল-হিজ্জাহ, মুহাররম ও রজব এ চারটি মাস ও আশুরার রোজার যে ফজীলত বর্ণনা করা হয়েছে সেটা অবশ্য রমজান ব্যতীত বাকি এগারো মাসের দিকে লক্ষ্য করে। কারণ সবচেয়ে সম্মানিত মাস হলো রমজান। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট হাদিসও রয়েছে । হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সা.-কে ‘আশুরার দিনের সওমের উপরে অন্য কোন দিনের সওমকে প্রাধান্য প্রদান করতে দেখিনি এবং এ মাস অর্থাৎ রমজান মাস (এর উপর অন্য মাসের গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখিনি)। (সহিহ বুখারী-২০০৬-হাদিসের মান: সহিহ )।


অন্য হাদিসে আবূ হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত আছে : তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.বলেছেন, রমাজান মাসের পর আল্লাহর মাস মুহররম-এর সওম হচ্ছে সর্বোত্তম এবং ফরয সালাতের পর রাতের সলাতই সর্বোত্তম। (সুনানে আবু দাউদ-২৪২৯-হাদিসের মান: সহিহ )। উপরোক্ত দুটি হাদিসের আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, সবচেয়ে সম্মানিত মাস হলো রমজান এবং সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ রোজা হলো রমজানের রোজা। বাকি এগারো মাসের তুলনায় আশুরার রোজা সম্মানিত ও ফজীলতপূর্ণ।


আশুরার রোজার নিয়ম

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আশুরার রোজা রাখলে ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখের রোজাও রাখা উচিত। এর উদ্দেশ্য হলো ইহুদি ও খ্রিস্টানদের থেকে ভিন্নতা বজায় রাখা।

ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) বলেছেন, “আগামী বছর আমি ৯ তারিখেও রোজা রাখব, ইনশাআল্লাহ।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৪৬)


আশুরার রোজার স্তর

হাদিসের আলোকে আশুরার রোজার কয়েকটি স্তর রয়েছে:

১. শুধুমাত্র ১০ তারিখে রোজা রাখা।

২. ৯ এবং ১০ তারিখ উভয় দিন রোজা রাখা।

৩. মহররম মাসে যত বেশি সম্ভব নফল রোজা পালন করা।


নবী করিম (সা.) বলেছেন:

“রমজানের পর সর্বোত্তম সাওম হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৮২)


আশুরার বিদআত ও ভ্রান্ত প্রথা

আশুরার দিনকে ঘিরে অনেক বিদআত ও ভ্রান্ত প্রথার প্রচলন রয়েছে। যেমন:

  • খিচুড়ি রান্না করা
  • মেহেদি লাগানো
  • গোসল ও সুরমা ব্যবহার
  • আনন্দ-উৎসব করা

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন,

“এসব প্রথার কোনো ভিত্তি নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) কিংবা সাহাবিদের কাছ থেকে এ ধরনের কোনো আমলের প্রমাণ পাওয়া যায় না।”


উপসংহার:

মহররম ও আশুরার তাৎপর্য সম্পর্কে জানলে স্পষ্ট হয় যে এটি শুধু একটি পবিত্র মাস নয়, বরং এটি ইসলামের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ। এ মাসে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও নফল রোজা পালন করে আমরা মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। তবে এ সময়ে কোনো বিদআত বা ভ্রান্ত প্রথায় লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা আমাদের দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা আমাদের মহররম মাসের পবিত্রতা রক্ষা করার তাওফিক দিন। আমিন।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url